মুনার অচনা শহর | ষষ্ঠ পর্ব

আমার অর্নাস শেষ। আমরা চার বোন আর মা ঢাকাতেই থাকি। এর মধ্যে আমার একটা স্কুলে চাকরি হয়ে যায়। কাজে মন দিচ্ছি রোজ, রোজ ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে শিখছি। পারলে দিনের সবটা সময় ওদের দিচ্ছি, কারণ একটাই। বাসায় গেলে মা, বিয়ের জন্যে চাপ দেবেন। ভালো লাগে না কিছুদিন আগে জাহিদ কিবরিয়াকে কি এমন বোঝিয়েছে কে জানে! না হলে আমার বিয়ে ভাঙ্গার পর থেকে লোকজন যেভাবে আমার দিকে তাকিয়েছে। মুখের উপরে যে কথাগুলো বলেছে। এর থেকে এক গাদা থু ছিটিয়ে দিলেও এমন খারাপ লাগতো না। আজ হাফ ক্লাস। তাই দুপুরে বাসায় ফিরে গেলাম।

দরজা খোলা। বাড়ির পরিবেশ অনেকটা রমরমে। মনে হচ্ছে একটু আগে মেহমানদারি করা হয়েছে। এই সময়ে মা শুধু বাড়িতে থাকে। বড় বুবু জব করে, আমি স্কুলে যাই। মিশু তো অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে, সে এখন কলেজেই থাকে। তার মাহী বোধ হয় স্কুল ছুটে হয়েছে, এখন সে কোচিং করে বাড়ি ফিরবে। মিশু বলেছে আসার পথে মাহীকে নিয়ে আসবে। তাহলে এতো আয়োজন কখন হলো, কিভাবে? চিন্তা ছেড়ে মাকে ডাকলাম।

— মা, কই তুমি? এইগুলা কি? এতো ফল, মিষ্টি! কে এসেছিলো গো।

বলতে বলতে ব্যাগ বিছানায় ফেলে রান্নাঘরের দিকে এগুচ্ছি।

— মা, কই গো তুমি।

মা আমার দিকে মুখ করেই একটা গোটা মিষ্টি মুখে ঢুকিয়ে দিলো।

— খে নে আগে, সুখবর আছে।

পুরো মিষ্টি হুট করে মুখে দেওয়াতে অবস্থা খারাপ। তবুও খাচ্ছি আর বলছি।

— এইগুলো কে আনলো? আবার জাহিদ টাহিদ আসেনি তো।

— এহ, খালি নিজের চিন্তা। মিনুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

— কি বলছো? বুবু রাজি হলো?

— হবে না কেন? সে নিজেই পাত্রের পরিবারের জন্যে কিনে দিয়ে অফিস গেছে।

— সেকি, এটা তো ভালো খবর। ছেলে কি করে?

— তোর বুবুর অফিসের বস।

— মানে, এতো রাজ কপাল আমার বুবুর।

— তবে। বোঝ তাহলে। একবারে পাকা কথা হয়ে গেছে।

— এতো তাড়াতাড়ি?

— হুম, ওরা দেরী করতে চায় না।

বড়লোকের প্রতি আমার তীব্র ঘৃনা সেটা সীমান্ত আমাকে বিয়ে করার কথা দিয়ে, বিয়ে না করলে সে ঘৃনা তীব্রতর ধারণ করছে। বুবুর বিয়ে নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা ছিলো কিন্তু বিয়ে হচ্ছিল না দেখে, আমরা ধরে নিয়েছিলাম সে বিয়ে করতে চায় না। আসলে গল্পটা অন্যরকম ছিলো।

গল্পটা জানার জন্যে বুবুর সাথে কথা বলা জুরুরি। সে ফিরলো রাতে। অন্যদিনের তুলনাতে তাড়াতাড়ি একটু। বিয়ে বলে কথা। খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে বুবুকে জিজ্ঞেস করলাম। কেন? এই খানেই বিয়ে করছে কেন? এতো ভালো ঘরে বছর খানেক আগে রাজি হলে কি হত তার। বাবা তো তার চোখের মনিকে সংসার করতে দেখে যেতে পারবেন। জীবনে করা সবচেয়ে ভুলের থেকে মুক্তি পেতেন। উত্তরটা অন্যরকম ছিলো।

— জানিস, আমি বলতে গেলে লাভ ম্যারেজ করছি।

— সেকি বুবু বসের সাথে লাভ ম্যারেজ। এতো মজার গল্প।এটা আবার কোন ম্যাজিক।

— এটা মেহেরুন আক্তার মিনুর ম্যাজিক নারে এটা সাইদ হোসেনের দুই ছেলের মর্জিতে একটা মায়ের ম্যাজিক মাত্র।

— মানে?

— তিনি বিবাহিত। তার স্ত্রী মারা গেছে। তার ছ বছরে দুই ছেলে আছে। একটার নাম পাভেল, আরেকটার হিমেল। ওরা জমজ। তাদের মায়ের চলে যাওয়ার পরে ছেলেগুলো শারীরিক মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। তুই তো ওদের দেখিস নি, দেখলে বুঝতি মায়া লাগে দেখলে। আহারে, মা না খাইয়ে দিলে খেত না তারা। এখন বাবার উপরে দায়িত্বটা পড়ে। ছেলেদুটি বাবা জন্যে অফিসে বসে থাকতো। ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং হতো, চুপটি করে বসে থাকতো। ওদের মা নাকি বছর দুএক মারা গেছে। এখন ওদের স্কুলে যাওয়ার বয়স, খেলার বয়স।

— হু। আর তুমি ওদের আদর করতে?

— শুধু আদর নয়। ওদের জন্যে খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতাম। খায়িয়ে দিতাম। ঘুম পাড়িয়ে ড্রাইভারকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম। ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেল।

— হু। জানি এটা তোমার ম্যাজিক।

— হুম। কদিন আগে ছেলে দুটোই ভীষণ জ্বরে পড়লো, সাইদ সাহেব শুনে বাড়িতে গেল। তিনি আবার আমায় নিতে ফিরে এলো। বাচ্চারা আমায় মা বলে ডাকে। মিষ্টি মা ও বলে। ওরা নাকি আমায় দেখতে চাইছে। বাচ্চাদের সাথে আমার কানেকশন দেখে সাইদ সাহেব অনেকটা থ হয়ে গিয়েছিলো। এতো তাড়াতাড়ি ওদের কিভাবে আপন করলাম নিজেও জানি না।

— তারপর।

— সে আমায় পরের দিন প্রোপোজ করলো। বিয়ে করতে চায় বললো। আমি বললাম আমার ফ্যামিলি আছে। সে বললো” আপনি কি রাজি ” আমি তখন সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না কি করবো।

— হু, তুমি শেষে রাজি হলে!

— হলাম, হিমেল, পাভেলের মা হলে দোষের কি? ছেলেগুলোকে দেখে মনে হয়। আমার ছেলে। জানিস আজ আমি ওদের নিয়ে যখন শপিং করছিলাম, ওরা বাবার কোলে না গিয়ে বারবার আমার কাছে আসে। আমার মা আমার মা করে ঝগড়া করে। কিভাবে ফেরাবো ছোট্ট ছোট্ট দুটো প্রাণকে।

— কিন্তু তারা যদি বড় হয়ে তোমাকে ভুল বোঝে!!

— সেটা ভবিষ্যতের কথা তাই ওদের বর্তমান মিটিং এর বাইরের রেস্ট রুমে আমি কাটতে দিতে পারি না।

বুবু আর তার ছেলেদের এক হতে আমরা কেউ আর বাধা দেইনি। চারদিকে অসীম আনন্দ, উচ্ছাস, নতুন কলরবে বাড়ি জমজমাট। পরিবারে নতুন করে হিমেল, পাভেলকে পেলাম। সত্যি মায়াবি ছেলে দুটো। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুটোকে আমি আলাদা করে চিনতে পারি না। একদম এক লাগে। ইনফ্যাক্ট সাইদ দুলাভাইও ভুল করে। কিন্তু মিনু বুবু ভুল করে না। সে বুঝতে পারে কে পাভেল আর কে হিমেল। বড় বুবু বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে দেয়। আমি অবাক হয়ে যাই। চাকরি কেন ছাড়বে সে। বুবুর কথা সে চায় না হিমেল, পাভেলের কষ্ট আর হোক, সে ওদের মা হতে চায়। আর শিক্ষিত মানেই চাকরি করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। হাউস ওয়াইফ মাদারও সন্তানদের মানুষ করতে সার্থকতা খুঁজে পায়। প্রথমেই বলেছিলাম না মেয়েটার মধ্যে মহৎ হওয়ার গুণ আছে।

বুবু ছাড়া বাড়ি ফাঁকা। বুবুর বিয়ের কিছুদিন পরেই মিশুর জন্যে ভালো সম্বন্ধ এসেছে। বিয়ের দিন নাকি মিশুকে দেখে পাত্রে ভালো লেগেছে। ছেলে কানাডায় বড় হয়েছে। মেয়ে হিসেবে একটা বাংলাদেশীই চাই। আমি ততক্ষণে নিজের ছোট বোনের বিয়েতে রায় দিয়ে ফেলেছি। চাইনা তার জীবনে কোনো সীমান্ত আসুক এর আগে বিয়ে হয়ে যাওয়া ভালো। তাছাড়া আমার মতো তো সে চিরকুমারী থাকার শখ নেই। আমরা ধীরে ধীরে আগুচ্ছি। সাইদ দুলাভাই আর নুজাত দুলাভাই খোঁজখবর নিচ্ছে। পাত্রের বাড়ি গিয়ে দেখাশুনা হয়ে গেছে। এরমধ্যে একদিন রাতে খটখট শব্দে ঘুম ভাঙ্গল, ঘরিতে দেখি রাত দুটো পনের। এতো রাতে কে? বাতি জ্বালিয়ে দেখি মিশু আমার পাশে নেই। কোথায় গেল। দরজার খোলা, দু রুমের ঘরে মিশুকে না পেয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামছি। মেয়েটা মেইন দরজায় তালা খুলছে। তার মানে মাত্রই বের হয়েছে। আমি বেশ নরলাম ভাবে ডাকলাম, মিশু।

সে ফিরে তাকালো। হাতের ব্যাগ ফেলে দিলো। আমি ব্যাগ তুলে নিয়ে মিশুকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। রাতে চেঁচামেচি করা ঠিক হবে না। তাই নরমালভাবে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। হয়তো আমি এর মানে জানি। সে রাজি নয় এই বিয়েতে। আমরাও ভালো একবার জানার কথাও ভাবেনি। তাহলে তার জীবনেও কোনো সীমান্ত রয়েছে? যে গোলাপ হাতে দাড়িয়ে থাকে। সেদিন রাত আমি ঘুমায়নি। সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মিশুকে দিলাম।

— ঘুম হয়েছিলো?

— হুম।

— আমি তো দেখলাম হয়নি। এপাশ ওপাশ করছিস। নে চা খা ভালো লাগবে।

মিশু চাতে চুমুক দিলো। থাক খেয়ে নিক, তারপরে বলি।

— তারপর মিশু! ছেলেটা কে?

— অর্নব।

— পুরো নাম!

— উইলিয়াম অর্নব।

— খ্রিস্টার্ন?

— হুম।

— তাই বলি, তুমি লাল শাড়ি ছেড়ে সাদা গ্রাউন গুলোকে কেন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছিলে।

— মুনা আপা। সে খুব ভালো ছেলে।

— আচ্ছা। প্রেম হলো কিভাবে?

— একবার ঝড়ের দিন। বিকেলটা সন্ধ্যার মতো লাগছে! আমি কলেজের থেকে একটু সামনে এসেছি রিকশা খুজতে! সেও রিকশা খুঁজছে।

— তখন ওকে চিনতি।

— হুম আমরা সেইম ব্যাচ।

— তারপর।

— সে দুটো রিকশা খুঁজেছে।

— দুটো কেন?

— একটা আমার জন্যে, আরেকটা তার জন্য।

— মানে!

— সে অনেক ভালো। নাহলে কি কেউ দুটো রিকশা খুঁজে। একটাই নিতে পারতো।

আমি বুঝতে পারছিলাম না তাকে কিভাবে বোঝাবো। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমিও গিয়েছি। অনুভূতিগুলো কেমন হয় জানি। কিন্তু এই বিয়ে ভাঙ্গতে হবে। মিশুর জন্যে কোনো অচেনা ছেলের জীবন নষ্ট হোক চাই না। চাই না আমি।

চলবে-

আরো পড়ুন: এ কেমন নির্মমতা!